মোহাম্মদ হাবীব উল্যাহ্
সাদিয়া আফরিন প্রাপ্তি অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী। মাত্র দেড় বছর বয়সে তার থ্যালাসেমিয়া রোগ ধরা পড়ে। এরপর থেকে গত ১১ বছর ধরে চলছে তার চিকিৎসা। এ পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে অনেক টাকা। মেয়ের চিকিৎসা খরচ জোগাতে সহায় সম্পদের অনেকটা বিক্রি করে দিয়েছেন এক অসহায় শিক্ষক বাবা। এখনো তার চিকিৎসা চলছে।
এর মধ্যে চার বছর আগে সাদিয়া আফরিন প্রাপ্তির ভাই আবু বকর আল ফাহিমের জন্ম। মাত্র ১৭ মাস বয়সে হঠাৎ করে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ে ফাহিম। এরপর পরীক্ষা-নিরিক্ষায় তারও থ্যালাসেমিয়া রোগ ধরা পড়ে। এবার মাথায় হাত সেই শিক্ষক বাবার। মেয়ের চিকিৎসায় যখন সর্বস্বান্ত হওয়ার পথে। তখন ছেলের এমন অবস্থা।
কি করবেন, কোথায় যাবেন সেই শিক্ষক বাবা ? নিরুপায় হয়ে ঋণ, আর ধার-দেনা করে ছেলে ফাহিমেরও চিকিৎসা শুরু করলেন। এ সময়ে আবার তিনিও খুব বেশি অসুস্থ হয়ে পড়লেন। আবারো ঋণ, ধার-দেনা করে এবার নিজের চিকিৎসা করাতে গিয়ে জানতে পারলেন, তিনি কিডনি রোগে আক্রান্ত। জরুরি অপারেশন প্রয়োজন।
যেখানে ছেলে ও মেয়ের চিকিৎসা খরচ জোগাতেই পারছেন না, সেখানে নিজের চিকিৎসা করাবেন কি দিয়ে। তাই-তো কান্না আর মৃত্যুর প্রহর গুনা ছাড়া কোন কাজ নেই সেই শিক্ষকের। বলছি, হাজীগঞ্জের শাহপরান নামের এক শিক্ষকের অসহায়ত্বের কথা।
তিনি উপজেলা শহরের একটি বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে (কিন্ডার গার্টেন ও জুনিয়র হাই স্কুল) সহকারি শিক্ষক পদে কর্মরত। কর্মজীবন শুরুর পর বিয়ে করেন। কোল জুড়ে আসে প্রথম সন্তান। নাম রাখেন, সাদিয়া আফরিন প্রাপ্তি। শাহপরান যে কয় টাকা বেতন পান, তা দিয়েই স্ত্রী ও সন্তান নিয়েই ভালোই চলছিল।
কিন্তু প্রথম সন্তান হওয়ার মাত্র দেড় বছর বয়স থেকে থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার পর তার দুঃখ গাঁথা জীবন শুরু। সেই সন্তানের বয়স এখন ১৪ বছর। অস্টম শ্রেণিতে পড়ালেখা করে। শারীরিক সমস্যার কারণে সে ঠিক মতো পড়ালেখা করতে পারছে না। থ্যালাসেমিয়া থ্রেডের কারণে নিয়মিত ঔষধ সেবন ও রক্ত দিতে হয়।
অপর দিকে ছেলে আবু বকর আল ফাহিমের ১৭ মাস বয়সে ধরা পড়ে থ্যালাসেমিয়া থ্রেড বা থ্যালাসেমিয়া মেজর। গত আড়াই বছর ধরে চলছে তার চিকিৎসা। কিছু দিন আগে তার মুখের প্রতিটি দাঁতের মাড়িতে ও পায়খানার রাস্তা ক্ষত দেখা দিয়েছে। এর মধ্যে কিডনি রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েন শিক্ষক শাহপরান।
এমন অবস্থায় ঠিক কি করবেন, তা বুঝতে উঠতে পারছেন না শাহপরান। তিনি নিজেই যখন রোগাক্রান্ত হয়ে পড়লেন। তখন ছেলে মেয়ের কি অবস্থা হবে, সেই উত্তর খুঁজছেন তিনি। নিজের শারিরিক অসুস্থতা ও টাকার আর টাকার অভাবে নিজে এবং ছেলে ও মেয়ের মৃত্যুর প্রহর গুনা ছাড়া আর কোন বিকল্প কিছু দেখছেনা তিনি।
শাহ পরানের স্ত্রী শাহনাজ আক্তার জানান, স্বামীর অল্প আয়ে ভালোই চলছিল আমাদের সুখের সংসার। প্রথম সন্তানটি অসুস্থতায অনেক সম্পদ হারিয়েছি। ভাবছি ঠিক হয়ে যাবে। পরের সন্তানটি ছেলে হওয়ায় খুশিতে ছিলাম। ১৭ মাস বয়সে যখন ছেলেরও থ্যালাসেমিয়া মেজর ধরা পরলো। তখন আমাদের মাথায় যেন বাঁঝ পড়লো।
তিনি বলেন, অর্থনৈতিকভাবে যখন কোন কুল-কিনারা পাচ্ছি না, ঠিক তখনি আমার জীবনে নেমে আসে আরেক মহা-দূর্যোগ। স্বামীর কিডনিতে পাথর ধরা পড়েছে। এখন পরিবারের ৪ জনের মধ্যে আমি অভাগা ছাড়া স্বামী আর দুই সন্তান দূরারোগে আক্রান্ত। কি করবো আমি, আমাদের-তো কপালটাই যেন অন্ধকারে ঢাকা।
শিক্ষক শাহপরান বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের কত হাজার হাজার মানুষকে বিভিন্নভাবে সহায়তা দিয়ে থাকেন। তিনি যদি আমায় একটু সহায়তা করতেন, তাহলে আমি ও আমার পরিবার উপকৃত হতো।
এ সময় তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, আসলে আমি সম্ভবত আল্লাহর একজন পাপী বান্ধা। তা না হলে রাব্বুল আলামীন কেন আমাকে এতোসব জটিল সব রোগ দিলেন। বুকের দুটি ধন, দুজনই থ্যালাসেমিয়া মেজর আক্রান্ত। আর আমি নিজেও কিডনি রোগে আক্রান্ত হয়ে আছি। দুই সন্তানকে চিকিৎসা করিয়ে আমরা সর্বস্ব শেষ করে ফেলেছি । এখন আমি নিজে কি দিয়ে চিকিৎসা করাবো আর সন্তানদেরকে কি দিয়ে সবসময় চিকিৎসা চলাবো।
এক প্রশ্নে শাহ পরান বলেন, সরকারিভাবে আমি হাজার দশের টাকা অনুদান পেয়েছি আর আমাদের সাংসদ মেজর অব.রফিকুল ইসলাম বীর উত্তম এমপি আমার থেকে চিকিৎসা সংক্রান্ত কাগজপত্রসহ অনুদানের আবেদন নিয়েছেন। উনি নিজে আমাকে ফোন দিয়ে খোঁজ নিচ্ছেন । তার সাথে যোগাযোগ ও পার্সোনাল বিকাশ নম্বর 01623-794946।
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মো. গোলাম মাওলা জানান, সাধারনত থ্যালাসেমিয়া রোগীর তথ্য পেলে আমরা সংশ্লিষ্ট দপ্তরে ফরম পূরন করে পাঠানো হয়। এই পরিবারটিকেও একই ব্যবস্থা করা হয়েছে। তিনি বলেন, আমাদের হাসপাতাল থেকে যা করা সম্ভব, এই পরিবারের জন্য আমরা তাই করছি।